Monday, August 19, 2019

শেখার আছে অনেক কিছু:

শেখার আছে অনেক কিছু:
==================
বরুড়া প্রতিদিন
♦ ২০০০সাল। আমার মা তখন প্রেগন্যান্ট। মায়ের পেটে আমাদের গোল্ডেন সিস্টার আদুরে ছোট বোন আফসানা। আফসানা এই পর্যন্ত তিন টা গোল্ডেন জিপিএ ৫ পাওয়ায় এই নাম তার।
মা খুব অসুস্থ ছিলেন তখন। আমাদের অভাব ও তুঙ্গে।
বাবা তখন বেকার। ঘরে বাজার নেই,চাল, ডাল, তেল, নুন কিছুই নেই।।
একটা নীরব হাহাকার এর ভিতর দিয়ে আমরা যাচ্ছি।
আমার এক কাকা তখন থাকতেন কুমিল্লা শহর এর নানুয়া দিঘীর দক্ষিন পাড়ে শরীফ মঞ্জিলে।
উনি কুয়েত এ থাকিতেন। অনেক টাকা উনার তখন।
দেশে আসার পর আম্মা আমাকে নিয়ে উনার বাসায় গেলেন।২০০০ টাকা ধার চাইলেন।
মা অনেক কাকুতি মিনতি করলেন।
আমরা না খেয়ে আছি,মা এর শরীর টা ভাল না এইসব বুঝালেন।।কাকা মাথা নাড়লেন।
আমি ও মা একটা আশা নিয়ে রাত কাটালাম উনার বাসায়।
পরের দিন আসার সময় আমার হাতে উনি ২০ টাকার দুইটা নোট ধরিয়ে দিলেন।
উনার বাসা থেকে টমছম ব্রিজ এর রিক্সা ভাড়া ছিল ৫ টাকা,বাসে টমছম ব্রিজ থেকে বলাকা বাসে আড্ডা বাজার এর ভাড়া ছিল ১৭ টা,দুইজনের ৩৪ টাকা লাগিল।উনি আমাদের ১ টাকা বেশি দিয়েছিলেন।
আমার মা বাস জার্নি করতে পারেন না,মোশন সিক্নেস এর জন্য উনি বমি করে অস্থির হয়ে যান।
অনেক আশা নিয়ে কাকার বাসায় গিয়েছিলেন মা।
আমরা যখন বাড়ি ফিরি, তখন অনেক বৃষ্টি হচ্ছিল।
বৃষ্টি ও মা এর কান্না একাকার হয়ে ঝরছিল।
সেদিন এর কথা আজো ভুলি নি।।
♥#২০০১ সাল----------------------
আমি আমার স্কুলের ফাস্ট বয় ছিলাম।
এস এস সি তে জিপিএ পেলাম ৪.২৫। আমরা
গ্রেডিং এর ফাস্ট ব্যাচ হওয়াতে স্যারেরাই বুঝতনা গ্রেডিং।না হলে পয়েন্ট আরো বেশি হত।
আমার খালা আমার এস এস সি পাশের খবর পেয়ে আমার মা কে বল্লেন আমাকে কলেজ এ না পড়িয়ে অটোমোবাইল এর ওয়ার্কশপ এ ভর্তি করে দিতে।
কাজ শিখা অবস্থায় ৫০০০ টাকা পাব,কাজ শিখে ফেললে বেতন ১০,০০০/ টাকা হবে।
আমিও চলতে পারবো,মা এর সংসারের হাল ও ধরতে পারব।।
ভুলিনি সেইদিনের খালার দরদী পরামর্শ।।
কলেজ এ পড়ার সময় আমি ফাস্ট ইয়ার ফাইলাম এক্সাম না দিয়ে ঢাকা চলে গিয়েছিলাম।
একদিন ছিলাম খালার বাসায়।
আমরা গরীব বলে আমাকে খাটে শুতে দিলেন না।
ড্রয়িং রুমে বিছানা করে দিলেন।
তখন শীতকাল ছিল।খালা আমাকে খুব আদর করতেন।
তাই কনকনে শীতের রাতে আমাকে একটা লেপ দিয়েছিলেন।
আমার তখন ভাল কোন শার্ট ছিল না।
খালার কাছে দুইটা পুরাতন শার্ট চাইলাম।
খালা বল্ল, এখন ত বাসায় পুরাতন শার্ট নেই,সব ফকির দের দাণ করে দিছি,আচ্ছা তোর ভাইরা শার্ট ফেলে দিলে ফকির কে না দিয়ে তোদের জন্য রাখব।।
সেদিন বুঝেছিলাম খালা আমাদের ফকির ভাবে।
খালার চার সন্তান এর বিয়েতে আমাদের কে দাওয়াত দেয়নি,কারন আমরা ফকির, আমাদের ভাল জামা নেই।
বড় লোকের বিয়েতে কি কাপড় পরে যাব আমরা?
খালার একটা প্রেস্টিজ আছে।।
বিয়েতে অন্য আত্নীয় রা যখন আম্মার কথা জিজ্ঞেস করত, তখন খালা বলত আম্মা অসুস্থ তাই যেতে পারেন নি।।
#১৯৯৬ সাল।।
ক্লাস সিক্স এ পড়ি।
আমার খালাত ভাই এর ট্রাভেল এজেন্সি ছিল।
আমার আব্বা কে মালয়েশিয়া পাঠাবেন বলে আমাদের জমি বিক্রির ৪০,০০০/টাকা নিয়েছিলেন।
পরে আমার বাবা কে বিদেশ ও পাঠাননি এবং আমাদের টাকাও ফেরত দেন নি।।
আমার মা নীরবে অশ্রু ফেলতেন।
আমার খালা আমাদের টাকা মেরে দিলেন।
বাবা প্রায়শই এই টাকা নিয়ে মায়ের সাথে ঝগড়া করে ভাত না খেয়ে থাকতেন।।
একটা দুর্বিষহ মানুষিক যন্ত্রনার মধ্যদিয়ে আমাদের কৈশোর কেটেছে।।
#১৯৯৮ সন।।
চারদিকে বন্যা।।
সব কিছুর চড়া দাম।
দিনে এক বেলা খাওয়াও কঠিন।।
বাজার থেকে ১/২ কেজি চাউল পলিথিন এ হাতে করে আনতাম।।
গরম ভাত এর সাথে একটা পেয়াজ ও গুড়ো মরিচ।
আহ কি স্বাদ।
ভাতের সাথে মাছ,মাংস খাব কল্পনাও করা সম্ভব ছিল না।
কুরবানির ঈদ ছাড়া আমরা গরুর মাংস চোখে দেখতাম না।
মা মাঝে মাঝে খেসারী ডালের বড়া বানাতেন।খেসারীর ডাল সস্তা ছিল।গরীবের ডাল।
এক প্লেট গরম ভাত।সাথে দুই টা খেসারীর ডালের বড়া।
মাঝে মধ্যে একটা ডিম পেয়াজ দিয়ে বিরাম করে চার ভাগের একভাগ জনপ্রতি।।
একদিন বড় বোন স্কুল থেকে এসে ভাতের সাথে পেয়াজ ও গুড়ো মরিচ দেখে না খেয়ে ভাতের প্লেট টা মেলা মেরে ফেলে দিয়েছিলেন।
সেই উড়ন্ত গরমভাতের প্লেটের ছবি টা আজো ভুলিনি।।
#২০০৩ সাল-----------
আব্বা তখন স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপে স্টোর কীপার এর একটা চাকুরী পেলেন।ঢাকা থেকে বাড়ি এসে দেখেন আম্মা বাড়ি নেই,আমার বড় বোন ঘরের সামনে বসে কাঁদছে।
আফসানার তখন তিন বছর।
আব্বা কে দেখে দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে আব্বার কোলে উঠল।তারপর বল্ল দুই দিন ভাত খাইনি আব্বা।
চিনি দিয়ে পানি গুলে খাইছি।।।
মাছ দিয়ে ভাত খাবো আব্বা।।।।
কয়েকদিন আগে আব্বা এই কথা বলে কেঁদে দিয়েছেন।
এইচ এস সি পরীক্ষার ফরম ফিলাপ শুরু হইছে।
আমার সাথের অনেকের ই ফরম ফিলাপ শেষ।
আব্বা খুব টেনশন এ।
আমার আরেক কাকা বিদেশ থেকে আসলেন।
তিনি বল্লেন আমার ফরম ফিলাপের জন্য তিনি ৩০০০ টাকা দিবেন।আর একদিন বাকী।
সকালে কাকা বল্লেন আমি হাজীগঞ্জ যাচ্ছি, বিকালে এসে টাকা দিব।
কাকা বিকেল গড়িয়ে রাতেও আর ফিরে আসেন নি বাড়িতে।
আমি কলেজের ফাস্ট বয় ছিলাম। শামীম কাকা, যিনি আমার বাবার চাচাতো ভাই, প্রিন্সিপাল স্যার কে বলে বিনা টাকায় আমার ফরম ফিলাপ এর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
আমার নিজের আপন কাকা তিন দিন পর বাড়ি ফিরে খুব স্বস্থি পেয়েছিলেন,যাক বাবা বুদ্ধি করে তিন দিন পর বাড়ি আসাতে ৩০০০/ টাকা বেচে গেল।।
সেই দিনের কথাও ভুলিনি।
#মেডিকেলের কোচিংঃ
আমি ডাক্তার হতে চাইনি।
কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হবার খুব ইচ্ছে ছিল।
বায়োলজি ছিল অপশনাল।
আমি বায়োলজি পড়িনি বাবার উপর রাগ করে।
এবং এই সাব্জেক্ট পাল্টাতে আমি অনেক চেষ্টা করেছি।
আমার বাবা পরীক্ষার পর একটা সমিতি থেকে সুদে ১০০০০/ টাকা এনে আমাকে নিয়ে ঢাকায় রওয়ানা দিলেন।
রেটিনা কোচিং এ আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভর্তি করিয়ে দিলেন।
বাবা শুধু বলেছিলেন, আমার বিশ্বাস, দিলে টানে তুমি মেডিকেল এ চান্স পাবে।।
ঠিকমত লেখাপড়া করবে।।
পড়ার টেবিল এ বসলেই বাবার চেহারা টা ভেসে উঠত।
মেসে থাকতাম পূর্ব রাজা বাজার এ।
একদিন সকালে বুয়া আসেনি।
নাস্তা কই খাবো। নগদ টাকা নেই।
সেদিন আমার মেসের রুম মেট শাকিল ভাই ১২ টাকার নাস্তা ফ্রি করিয়েছিলেন।।
সেই ১২ টাকার স্নেহের কথা ভুলিনি।
ঢাকায় আমার খালার বাসা,মামার বাসা।
কারো বাসায় যাইনি।
#২০০৪ সন, ১০ এপ্রিল
আমি সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ এর ৪২তম ব্যাচের ছাত্র হিসেবে মেডিকেল জীবনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করি।
আমার বাবার বিশ্বাস টা বাস্তব হয়েছিল।
সেই দিন থেকেই আমি আমার পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলাম।
#দাদীর স্মৃতি ও ভালবাসাঃ
আমার দাদা ভাই হজ্জে গেলেন।
কুরবানির ঈদের পর গরুর চামড়া বিক্রির ১২০০ টাকা আমার দাদি আমাকে দিয়েছিলেন।
কাগজ কলম কেনার জন্য।সেই ১২০০ টাকা দেওয়ার অপরাধে আমার দাদি অন্য চাচী দের তোপের
মুখে পড়েছিলেন।।দাদী অপমানে কেঁদে ছিলেন।
সেই দিন কে ভুলা যায় না।
আমাদের কে খুব ভালবাসিতেন দাদী।
বাবা ছিল দাদীর কলিজা।কিন্ত ৬ ছেলে ২ মেয়ে এর বিশাল সংসারে দাদি ছিলেন অসহায়।
আমাদের কে দেবার মত শুধু ভালবাসা ও দোয়া ছাড়া আর কিছু ছিলনা উনার।
এস এস সি এক্সাম এর সময়ে আমার বড় বোনের এক জোড়া জুতা ছিল না।সে দাদির কাছে বায়না ধরল,এক জুড়া জুতার টাকার জন্য।দাদী দাদার আলমারি থেকে চুরি করে ২৫০ টাকা এনে দিয়েছিলেন।সেইদিন দাদির মুখে একটা সুখের ছায়া দেখেছিলাম।
আমাদের বায়না ধরার এই একটা জায়গা ছিল।
আম্মাকে দাদি মাঝে মাঝে ২০/৫০ টাকা এনে দিতেন সাবান, লবন, ডাল কেনার জন্য।
২০০০ সালে আমাদের ঘরের সবার চিকেনপক্স হল।
বাবার এত বেশী হয়েছিল, এখন মনে করলেও ভয় লাগে। সেদিন দাদী একটা ছাগল সদকা দেওয়ার মানত করেছিলেন, বিনিময় আল্লাহ যেন বাবা কে সুস্থ করে দেন।
দাদী গরুর মাংস খুব পছন্দ করতেন।
আমি মেডিকেল এ চান্স পাবার পর যতদিন বাসায় গিয়েছি,যাওয়ার সময় দাদির জন্য গরুর মাংস নিয়ে যেতাম।।দাদীর গরুর মাংস খাওয়ার দৃশ্য টা আজো ভুলিনি।।
মৃত্যুর কয়েক বছর আগে দাদী আমাদের উপর খুব নির্ভর হয়ে গেলেন।আমাদের ঘরে ঢুকে নিজ হাতে খাবার নিয়ে খেয়ে দাদাভাই এর জন্য নিয়ে যেতেন।
এই স্বাধীনতা অন্য কোথাও ছিল না।
আমরা যেদিন ১১ সেপ্টেম্বর ২০১১ তে কুমিল্লা শহরে চলে আসি সেদিন দাদী ও দাদাভাই খুব কেঁদে ছিলেন।
বলেছিলেন আমাদেরকে কার কাছে রেখে যাচ্ছো তোমরা।আমরা যখন চলে আসি, অশ্রুসিক্ত দাদির আমাদের পথ পানে চেয়ে থাকাটা আজো ভুলিনি।
ভালবাসার মানুষ এর অশ্রুজল এর কথা ভুলতে নেই।
দাদি ইন্তেকাল করেন ২৫ জানুয়ারি ২০১২ এর বিকেল বেলা।
আমি তখন ফেনীর কসমোপলিটন হাসপাতাল এর Resident Medical Officer.
ছুটি ম্যানেজ করে পরদিন ভোরে গ্রামে ফিরি,দাদির দাফন কাফন এর সব খরচ আমি দেই,একটি টাকাও উনার সন্তান দের লাগেনি।
ভালবাসি দাদি কে। কিছু ভালবাসা ফিরিয়ে দিতে পারায় মন হাল্কা লাগছে।
#দাদার স্মৃতিঃ আমার দাদাভাই প্রিন্সিপ্যাল মাওলানা আব্দুল মান্নান ওয়াজেদী ছিলেন আমাদের এলাকায় সু-পরিচিত এক ইসলামী ব্যক্তিত্ব।।
হাজারো আলেম এর উস্তাদ তিনি।
অন্য ছেলেদের বিরোধিতায় তিনি আমাদের জন্য খুব বেশি ভুমিকা রাখতে না পারলেও দোয়া দিয়ে গেছেন প্রাণভরে।
উনি প্রতি মুনাজাত এ বলতেন আল্লাহ যেন আমাকে উনার বংশের প্রদীপ বানিয়ে দেন।।
এই দোয়া আমি ভুলি কেম্নে।
দাদীর ইন্তেকাল এর পর আব্বা বাড়ি গেলেন উনাকে দেখতে,টাকা দিলেন,তখন আমি ব্যাংকক এ Australian Medical Council CaT 1 দিতে।
আব্বা দাদাভাই কে বললেন, জোবায়ের এর জন্য দোয়া করবেন,দাদাভাই বল্ল তার দোয়া চাইতে হবেনা।
দোয়া যে পৌঁছে তা কি টের পাচ্ছো না।
আমাদের জীবনে দাদাভাই এর দোয়ার ভুমিকা বিশাল।
দাদাভাই কে যখন ল্যাব এইড এর আইসিইউ তে নিয়ে যাই তখন এম্বুলেন্স চলতে শুরু করার পর দাদাভাই গাড়ি থামিয়ে আব্বাকে আবার ডাকিলেন।
আব্বার হাত ধরে বলেছিলেন " সফর যদি সংক্ষিপ্ত হয় তাহলে তোমার সাথে দেখা হবে, আর যদি সফর দীর্ঘ হয় তাহলে হাশর এর মাঠে দেখা হবে"
দাদার সফর দীর্ঘ হয়ে গিয়েছিল ।
কুমিল্লা মেডিকেল সেন্টারে দাদাভাই এর টেস্ট এর টাকা দেওয়ার লোক ছিল না সেদিন।
যারা উনার সব সম্পদ গিলে খেয়েছে তারা কেহ দেয়নি।
আমাদের তখন ক্রাইসিস। আমি ব্যাংকক থেকে ফিরছি মাত্র,বেকার,মাত্র ৫০০০/= টাকা ছিল,আমি আব্বার হাতে দিয়ে বল্লাম আমার কাছে আর ১ টাকাও নেই,দাদাভাই এর সময় আর বেশি নেই, এটা উনার হাতে দেন।
দাদাভাই মৃত্যুর আগে আমার দেওয়া টাকা ই হাতে নিলেন।আর কারো সেই সুভাগ্য হয়নি।
ল্যাব এইড এ যখন দাদাভাই কে ভেন্টিলেটর এ দেওয়া হয় তখন তিনি আমার হাতে ধরে বলেছিলেন, তোদের অনেক বঞ্চিত করেছি,তোদের জন্য মায়া হয়।
রাতে ফ্লোরে ঘুমিয়ে দাদার অন্তিম সময়ে সেবা করে পাশে থেকে যে দোয়া পেয়েছি, তার জন্যই আজকের এই আলোময় জীবন।।।
#অভাবের দিনগুলি তে খাবারের পাশাপাশি কাপড়চোপড় এ আমরা অনেক কষ্ট পেয়েছি।
আম্মার একটা কাপড় ছিল। দিনে গোসল করতেন না।
রাতে গোসল করে পেটিকোট আর ব্লাউজ পরে ঘুমাতেন,ভেজা কাপড় টা শুকালে সকালে পড়তেন।
১৫ দিন পর আব্বা বেতন পাওয়ার পর দুইটা জনি প্রিন্টের কাপড় এনেছিলেন।
সেই দিন ভুলতে পারবো না।।
তাই এখন আমি যতবার কুমিল্লা যাই আম্মার জন্য আড়ং থেকে কাপড় কিনে নিয়ে যাই।।
আজকে যখন আম্মাকে বল্লাম সেই দিনের কথা, আম্মা বলল সেইদিন কাপড় ছিলনা বলে আজ শুধু আড়ং এর ৫০ টা কাপড় আলহামদুলিল্লাহ।
একদিন বিকেল বেলা, সবাই ঘুমাচ্ছে, আমি উঠে দেখি সকালে যেই কাপড় টা সিলেট থেকে নিয়েছি সেটা
একা একা গায়ে জড়িয়ে আয়নায় নিজেকে দেখছেন।
আমি চুপিচুপি পুরো ব্যাপার টা খেয়াল করলাম।
যদিও সকালে কাপড় টা নেওয়াতে খুব রাগ দেখালেন,মিতব্যয়ী হওয়ার জন্য লেকচার দিলেন।
বাবা মা এর জন্য আমি আজীবন অপচয় করব।
সেই দৃশ্য যে কতটা সুখের তা আমি জানি।
#১৯৯৩ সালে কুয়েত গিয়ে ১৯৯৬ সালে বাবা দেশে চলে আসেন।আমি তখন সিক্স এ পড়ি।
১৯৯৬ থেকে ২০০৪ এই আট বছর আব্বা বেকার ছিলেন।আমাদের জীবনের বেশি নিষ্ঠুরতা এসেছিল এই সময় টাতে।
অভাব আস্তে আস্তে আমাদের গ্রাস করে নিল।
আব্বা ১৯৯৬ সালে একটা লুঙ্গি কুয়েত ফেলে এসেছিলেন,৪ বছর পর জেঠা ২০০০ সালে দেশে আসার সময় এই লুঙ্গি টা নিয়ে এসে উনি বাড়িতে তিন মাস পরেন।যেদিন উনি আবার বিদেশ গেলেন সেদিন আম্মা সেই লুঙ্গি এনে গরম পানি দিয়ে ধুয়ে শুকিয়ে আব্বাকে দেন।আব্বা সেই লুঙ্গি এক বছর পরেছিলেন।
সেই মলিন লুঙ্গির চেহারা আজো ভুলতে পারিনি।
কত টা খারাপ ছিল সেই সময়।।
গত বছর শুধু আব্বার কাপড় রাখার জন্য আমি ৪৬হাজার টাকা দিয়ে হাতিল থেকে একটা আলমারি দেই।
# আমি যখন এস এস সি পরীক্ষা দেই,তখন আমার এক্টা প্যান্ট ছিল না।আমি আমার বাবার একটা পুরাতন প্যান্ট ছোট করে পড়েছিলাম।
আমি ক্লাস ৮ এ যেই প্যান্ট বানিয়েছিলাম সেটা ক্লাস ১০ এ গিয়ে ছোট হয়ে গেল।সেটা পরলে
ক্লাসের বান্ধবী রা হাসাহাসি করত।
স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে এস এস সি এক্সাম দিয়েছি।
এক জোড়া জুতা ছিল না।।
কাপড়চোপড় এর কষ্ট গুলো আমি নিতে পারিনা।
যখন এইস এস সি এক্সাম দেই তখন পুরো পরীক্ষা একটা ৪০ টাকার বাঘ এর চিত্র আঁকা টি শার্ট পড়ে দিয়েছি।
আজ আমার জামা কাপড় অনেক মানুষ গায়ে দেয় আলহামদুলিল্লাহ।।
অনেক কে আমি জামা কাপড় কিনে দেই।
কিন্ত সেই দিনের কথাগুলো কেম্নে ভুলিব।
প্রথম ও ২য় লেখার প্রতিটি শব্দ আগের লিখা পড়ে যারা অশ্রুসিক্ত হয়েছেন, সেই অশ্রুজল এর মত পবিত্র ও সত্য।এটা আমাদের নিষ্ঠুর যাপিত জীবনের কিছু খন্ড চিত্র।
#সোহাগের কথাঃ
আমরা তিন ভাই এর দ্বিতীয় হল সোহাগ।।
সোহাগ যখন ক্লাস ১০ এ পড়ত তখন আমার এক চাচাত ভাইকে প্রাইভেট পড়াত।
মাসে ১০০ টাকা।প্রথম মাস পড়ানোর পর টাকা দেওয়ার দিন চাচী বলল, সোহাগ তোর আম্মার কাছে ১০০ টাকা পাই।। তোর এই মাসের বেতন দিয়ে সেই টাকা পরিশোধ হয়ে গেল।
তার সেই দিনের চাপা কান্না ও কষ্ট টা আমি ভুলিনি।
আজ সোহাগ NSU থেকে বায়োটেকনোলজি তে মাস্টার্স শেষ করে USA টে PhD করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
সেই চাচাত ভাই কতদূর আগালো, সেটা আর নাই বা বল্লাম।

#২০০৫ আম্মার পিত্তথলি তে পাথর। প্রায়শই ব্যাথা হয়,সাথে Dysfunctional Uterine Bleeding.
একসাথে দুইটা অপারেশন দরকার।
আম্মা অপারেশন এর কথা শুনার পর থেকেই মানুষিক ভাবে ভেঙে পড়লেন।আমি তখন মেডিকেল এর সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি।
আমি গেলাম দেলোয়ার কাকার বাসায়।
উনি আমাকে দেখে হাসি দিলেন,তারপর সব শুনে বুয়েট এর Teachers Associations থেকে ১ লক্ষ টাকা লোন তুলে আমাকে দিলেন।
সেই অবদান ভুলার নয়।
আমাদের পরিবারের সারা বছর এর চাঊল উনি কিনে দিয়েছেন।
ড. দেলোয়ার কাকার একদিন আমাকে বললেন
জীবনে সুখী হতে চাও,কারো কাছে কিচ্ছু প্রত্যাশা করবেনা।
এটা জীবনে সুখী হওয়ার সুত্র।।
প্রতিদান প্রত্যাশা না করেই উনি আমাদের জীবন মায়ায় ভরিয়ে দিয়েছেন।
অফুরন্ত ভালবাসা ও সম্মান প্রিয় ড. দেলোয়ার কাকার জন্য।।
#শামীম কাকার কথাঃ
২০০১ সালঃ
এস এস সি পাশ করেছি।কলেজ এ কিভাবে ভর্তি হব এই চিন্তায় মগ্ন। একরাশ হতাশা ঘিরে ছিল।
একদিন পড়ন্ত বিকেল বেলা আব্বা আমাকে নিয়ে গেলেন শামীম কাকার কাছে।তখন কাকা গ্রামে এসেছেন।উনি আব্বার চাচাত ভাই।
SQ GROUP এর চেয়ারম্যান কাকা আব্বার সব কথা শুনলেন।
সাথে দাদী বসা ছিলেন।সব শুনে হতবিহ্বল হয়ে গেলেন উনারা।আমরা কেন কষ্টে থাকব এটা উনারা কুল কিনারা করতে পারলেন না?
দাদী তদন্ত করলেন।মরহুম হাবিব উল্লাহ দাদাভাই ও আমাদের ইউনিয়ন এর সাবেক চেয়ারম্যান আব্বার চাচা মরহুম খালেক দাদাভাই উনাদের বিস্তারিত জানালেন।।
একদিন দাদি ঢাকা থেকে খবর পাঠালেন, আব্বা যেন শামীম কাকার সাথে দেখা করে।
আব্বা গেলেন।কাকা আমাকে আড্ডা কলেজ এ ভর্তি হতে বল্লেন,২০ হাজার টাকা পরিবারে দিলেন।
আমি আড্ডা কলেজ এ পড়েছি,দুই বছর হোস্টেল এ থাকা ও খাওয়া, প্রাইভেট পড়ার স্যারদের সম্মানি, কলেজ এর বেতন, ফরম ফিলাপের জন্য আমার ১ টাকাও লাগেনি।সব কাকার অবদান।
আব্বা ২০০৪ এ আবার কুয়েত গেলেন,প্লেন এর টিকেট ভাড়ার জন্য কাকা ৩০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন।
ড. দেলোয়ার কাকার পাশাপাশি শামীম কাকাও আমাকে মেডিকেল এর ৫ বছর ফিন্যান্সিয়াল সাপোর্ট দিয়েছেন।
আমি এক কাকার টাকায় নিজে চলতাম,আরেকজন এর টাকায় ভাইবোন কে সাপোর্ট দিতাম।
নিজে কোচিং ও টিউশন এর টাকা মা এর জন্য পাঠাতাম।।
এই দুইজন মানুষ এর কাছে আমরা চিরঋণী।
#ডাক্তার হওয়ার পর ২০১০ সাল থেকে পুরো পরিবারের দায়িত্ব আমি নিজ কাঁধে নিয়ে নেই।
ভাইবোন গুলো লেখাপড়া করে অনেক দূর আগালো।
আমার মায়ের দুই মেয়ে মাস্টার্স এ পড়ে।
সোহাগ PhD প্রোগ্রাম এর প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত।
গোল্ডেন সিস্টার আফসানা কলেজ এ।
আমার বড় বোনের টুইন বাচ্চা ইরফান কুমিল্লা জিলা স্কুল এ ক্লাস সেভেন এ, আর ইন্তিহা মর্ডান স্কুলে।
বাবা কে হজ্জ করিয়ে আনলাম গতবছর।
২০১১ সাল থেকে আমরা কুমিল্লা শহরে থাকি।
#আমি একজন সেল্ফ এম্পলয়েড ডাক্তার।
নিজের প্রজেক্ট ডাঃ জোবায়ের মেডিকেয়ার সেন্টার এ কাজ করছি।
আমাকে যদি প্রশ্ন করেন " সুখ কি??
আমার উত্তর মা-বাবার মুখের হাসি।।
লেখক:  Dr. Jobayer Ahmed