Monday, September 18, 2017

বাংলাদেশ যেকারনে যুদ্ধে জরানো উচিত হবেনা।

আমাদের চেয়ে ২৬ র‍্যাংকিং এগিয়ে থাকা প্রতিবেশী’র সাথে যুদ্ধে নামাটা কতটা সমীচিন হবে একেবারেই আন্তর্জাতিক সমর্থন ছাড়া- সেটা যথেষ্ঠ চিন্তাভাবনার দাবী রাখে।

২৫ অগাস্ট রোহিঙ্গা বিষয়ক ঝামেলা শুরু হওয়ার পর থেকে মিয়ানমার যে শুধু রোহিঙ্গাদের আমাদের সীমান্তে পুশইন করছে- তা নয়। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলাদেশের আকাশসীমা বারবার লঙ্ঘন করছে। বাংলাদেশ এর প্রতিবাদে বারবার কূটনৈতিকভাবে প্রতিবাদলিপি-ই পাঠাচ্ছে, সামরিক কোন জবাব এখনো দেয়নি। কিন্তু কেন?
::

মিয়ানমারের দৃষ্টিকোণ থেকেই বিশ্লেষণ শুরু করি। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশের নাগরিক হিসেবে মিয়ানমার রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেয় না। তাদের ভাষ্যমতে, রোহিঙ্গারা বাঙালি, তাই তাদের বাংলাদেশেই ফেরত যাওয়া উচিৎ। কিন্তু শত বছর ধরে একটি এলাকায় বাস করে যাওয়া জনগোষ্ঠীকে এত সহজে তাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব না, অন্তত আধুনিক যুগে। কিন্তু তারপরেও তারা অত্যন্ত বর্বরতার সাথে রোহিঙ্গা বিতাড়ন শুরু করেছে, এবং একই সাথে আকাশসীমা লংঘন করে বারবার বাংলাদেশকে উস্কানি দিচ্ছে। কেননা আন্তর্জাতিক মহলে একটু-একটু করে শুরু হলেও গত এক সপ্তাহে রোহিঙ্গা ইস্যুটি বেশ বড় রকমের আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে।
::

মিয়ানমারের সম্ভবত আশা ছিলো, ক্রমাগত উস্কানিতে একটা না একটা সময় বাংলাদেশের ধৈর্য্যচ্যূতি ঘটবে এবং বাংলাদেশ সামরিকভাবে এর জবাব দিবে অনুপ্রবেশকারী একটি বার্মিজ হেলিকপ্টার ভূপাতিত করে। আর ঠিক যে মুহুর্তে এটা ঘটবে, সে মুহুর্তেই পুরো ঘটনা মোড় নিবে নতুন দিকে। শুরু হয়ে যাবে দু’দেশের সীমান্তযুদ্ধ, যা ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে দু’দেশের অভ্যন্তরেও। আন্তর্জাতিক আলোচনার টেবিলে তখন মূল প্রসঙ্গ হয়ে উঠবে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সংঘাত, আর রোহিঙ্গা ইস্যু চলে যাবে ব্যাকফুটে। সত্যি বলতে, এক সপ্তাহ পরে রোহিঙ্গাদের কথা আর কারো মনেই থাকবে না আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে। আর ঠিক এটাই চায় মিয়ানমার। বাংলাদেশকে কোনভাবে যুদ্ধে টেনে আনা মানেই এই দফায় তাদের স্বার্থ হাসিল হয়ে যাওয়া।
::

আন্তর্জাতিক সমর্থনের হিসাব তুললে মিয়ানমারের পাশে আছে চীন। আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সশরীরে মিয়ানমার গিয়ে সমর্থন জানিয়ে এসেছেন ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে’, যেখানে বাংলাদেশের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি ভারত জানিয়েছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে দিয়ে ফোনকলের মাধ্যমে। এ থেকেই পরিষ্কার যে আঞ্চলিক দুই সুপারপাওয়ারেরই সমর্থনের পাল্লা অনেকটাই ভারী মিয়ানমারের পক্ষে। আমেরিকা এখনো চুপচাপ, পরিষ্কার কিছু না বললেও আখেরে তারাও মিয়ানমারের দিকেই ঝুঁকবে। রাশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন জানিয়েছে মিয়ানমার সরকারের প্রতি।
: :

ক’বছর আগে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ব্রাত্য হয়ে থাকা সামরিক জান্তা-শাসিত দেশটির হঠাৎ এত কদর কেন? কেননা বেশ কয়েক দশক নিজেদের একঘরে করে রাখার পর ক’ বছর আগেই তারা তাদের বাজার খুলে দিয়েছে বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য।আর সে সুযোগে বানের পানির মত বিনিয়োগ ঢুকছে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এই দেশটিতে। বিনিয়োগকারীর এই লম্বা লিস্টে কে নেই? আমেরিকা, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ইসরায়েল, ভারত, পাকিস্তান আর সেই সাথে তাদের সবসময়ের বন্ধু চীন। এ কারণেই প্রায় সব সুপারপাওয়ারের কাছেই এ মুহুর্তে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি আরাধ্য মিয়ানমার। প্রত্যেকেরই বিনিয়োগের টাকা ঢুকছে দেশটিতে, যার কয়েকগুণ সবাই উসুল করে নিবে আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই।
::

উল্টোদিকে বাংলাদেশ পাশে পাবে মধ্যম কাতারের কয়েকটি মুসলিম দেশকে শুধু; যাদের মূল ফোকাস শুধুই নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের উপর, বাংলাদেশ না। তারা ঘরহারা রোহিঙ্গাদের সাহায্য করতে চায়, কিন্তু এর জের ধরে বাংলাদেশ-মিয়ানমার যুদ্ধ লাগলে তারা যে আমাদের সামরিকভাবে সাহায্য করবে বা করতে পারবে তা কিন্তু না, কেননা এতে মিয়ানমারের সমর্থনে থাকা সুপারপাওয়ারদের সাথে তাদের ব্যবসায়িক এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক অবনতির ভয় থাকে। তাই পূর্ণমাত্রার সামরিক সমরে বাংলাদেশ হয়ে পড়বে একেবারেই আন্তর্জাতিক বন্ধুহীন।
::

এবার আসি মিয়ানমারের চেয়ে সামরিক শক্তিতে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশের আলাপে। আমাদের অনেকের হয়তো ধারণা একবার যুদ্ধ শুরু হলে আমাদের সেনাবাহিনী এক সপ্তাহের মধ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে শায়েস্তা করে ফিরতে পারবে।
::

কিন্তু পরিসংখ্যান ভিন্ন কথা বলে। গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ারের হিসাব অনুযায়ী, মিয়ানমারের র‍্যাংকিং যেখানে ৩১, বাংলাদেশের ৫৭। এবং এখানে শুধু যে সৈন্যসংখ্যা, অস্ত্রসংখ্যা ইত্যাদি’র গণনা করে র‍্যাংকিং করা হয়েছে তা না, বরং সর্বমোট ৫০টির মত প্যারামিটার পর্যালোচনা করে এ হিসাব করা হয়েছে। হ্যাঁ, যুদ্ধের ময়দানে বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল খাটিয়ে বড় প্রতিপক্ষকে কাবু করেছে অপেক্ষাকৃত ছোট যোদ্ধাদল- এমন ইতিহাস ভুরি-ভুরি আছে। কিন্তু এই আশায় বুক বেঁধে অঘটন ঘটার কল্পনায় যুদ্ধে নামবে না কোন পেশাদার সামরিক বাহিনী।
::

সেই সাথে আছে MAD-এর আশংকা। MAD এর পূর্ণ রুপ “Mutually Assured Destruction”, যার সহজ বাংলা তরজমা দাঁড়ায়- “তুইও মরবি, তোকে মারতে গিয়ে আমিও মরবো”। যদিও এই Mad Doctrine পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তবে এখানে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের বর্তমান অর্থনীতিতেও যুদ্ধে জড়ানোর সিদ্ধান্ত একই প্রভাব রাখতে পারে।
::

দুইটি দেশই সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিকভাবে অনুন্নত দেশের কাতার থেকে উঠে আসার চেষ্টা করছে। এ অবস্থায় যুদ্ধে জড়ানো হবে নিজ পায়ে কুড়াল মারার চেয়েও ভয়াবহ সিদ্ধান্ত। যুদ্ধ যেমন রক্তপাতের হিসাবে সস্তা না, তেমনি এর অর্থনৈতিক প্রভাবও অকল্পনীয়। শুধু যে খরচের খাতা ভারী হবে, তা না। বিবদমান দু’টি দেশেরই লক্ষ্য থাকবে প্রতিপক্ষ প্রতিবেশীকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়া, যেন অদূর ভবিষ্যতে তারা আবার একে অপরের স্বার্থের বিরুদ্ধে যেতে না পারে। আর এর জের ধরে প্রতিপক্ষের আক্রমণে ধংস হবে দুই দেশেরই অর্থনীতির চালিকাশক্তি দেশীয় সম্পদ এবং বৈদেশিক বিনিয়োগগুলো। মুখ ফিরিয়ে নিবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং বিনিয়োগকারীরা। যার প্রভাবে মাথা গরম করে শুরু করে দেওয়া এক যুদ্ধের কুপ্রভাব কয়েক দশকেও কাটিয়ে ওঠা কষ্টকর হয়ে উঠবে দেশ দু’টির জন্য।
::

সুতরাং, যেখানে জাপান ১৬ ঘর পিছিয়ে থাকা উত্তর কোরিয়াকে জবাব দিতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে চিন্তাভাবনা করছে এত এত সুপারপাওয়ারের প্রত্যক্ষ সমর্থন থাকার পরেও, সেখানে আমাদের চেয়ে ২৬ র‍্যাংকিং এগিয়ে থাকা প্রতিবেশী’র সাথে যুদ্ধে নামাটা কতটা সমীচিন হবে একেবারেই আন্তর্জাতিক সমর্থন ছাড়া- সেটা যথেষ্ঠ চিন্তাভাবনার দাবী রাখে। আর এমন যদি হতো যে এই যুদ্ধ শুরু করলেই আমাদের প্রাথমিক যে লক্ষ্য- রোহিঙ্গাদের ঘরে পাঠানো, সেটা সফল হবে তা-ও কিন্তু না, যেটা উপরেই আলোচনা করেছি। বরং রোহিঙ্গাদের সাথে সাথে আমাদেরও দুর্দশা বাড়বে। আর যুদ্ধ যে শুধু সেনাবাহিনীর সাথে সেনাবাহিনীর হবে, তা কিন্তু না। বোমা পড়বে আপনার বাড়িতে, আপনার পরিবারের উপরও। আর অবস্থা খারাপের দিকে গেলে হয়তো আপনাকেও শরণার্থীর খাতায় নাম লেখাতে হতে পারে অচিরেই।
copied from Saeedul Mostafa

No comments:

Post a Comment